গত বছরের জুলাই মাসের শুরুর কথা। ঢাকায় প্রতিদিনের একঘেয়ে যাপিত জীবনে শরীর-মন দুটোই অবসন্ন। বন্ধুরা দলছুট, যেটুকু আড্ডা তাও হয় ভিডিও কলে। এদিকে শাহবাগসহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে চলছে কোটাবিরোধী বিক্ষোভ। যদিও আন্দোলনটা তখনো ছড়িয়ে পড়েনি। এমন পরিস্থিতি মনটাকে আরো বিষণ্ণ করে তোলে। মন ভালো করার অন্যতম ‘টোটকা’ হচ্ছে ঘুরতে যাওয়া, বন্ধুরা মিলে সেটাই সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু যাবটা কোথায়? সবাই একটা শান্ত-নীরব পরিবেশে একত্রে বসে আড্ডা দিতে পক্ষপাতি। অনেক আলোচনার পর ঠিক হলো আমরা টাঙ্গুয়ার হাওরে যাব।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’ এই হাওর প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। ঠিক হলো আমরা ১৬ জুলাই রাতে রওনা হব, ১৮ জুলাই রাতে ফিরতি পথে ঢাকা। এরই মধ্যে ১৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দমনে ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ হামলা চালায়। রাজধানীর শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পরিস্থিতি তখন উত্তাল।
এমন পরিস্থিতিতে ঢাকার বাইরে যাওয়া উচিত হবে কি না তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাই। এদিকে ঢাকার বাইরে থাকা বন্ধুরা চলে এসেছে। অফিস থেকে ছুটিও ম্যানেজ। পরিবহন ও হাউসবোটের ‘অ্যাডভান্স মানি’ দেওয়া হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে এক দোদুল্যমান অবস্থা। তবে যেভাবেই হোক এই নাগরিক কোলাহল থেকে মুক্তি চাইছিলাম। তাই ট্যুর প্ল্যানটা বাতিল না করে ১৬ জুলাই রাতে ১৬ জনের দল ভোরে সুনামগঞ্জে পৌঁছাই। সেখানে আরো এক বন্ধুদম্পতি যুক্ত হয়।
সুনামগঞ্জে ঢুকতেই শুরু হয় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি। ঢাকার দূষিত বাতাস থেকে বেরিয়ে হাওর অঞ্চলের ঝিরঝিরে ঠান্ডা সমীরণ-অনুভূতিটা স্বর্গীয় ছিল। আমরা একটি হাউসবোট ভাড়া নিয়েছিলাম।
এই বোটে করে পুরো হাওর আমরা ঘুরে দেখব। খাবারদাবার নিয়ে চিন্তা নেই। সব ব্যবস্থা ছিল এই জলযানে। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা বাস থেকে নেমে দুটি লেগুনা টাইপ বাহনে চড়ে ঘাটের কাছে চলে আসি। একটি প্রায় প্রতিকূল কর্দমাক্ত পথ বেয়ে হাউসবোটে উঠলে সেটি আমাদের নিয়ে রওনা হয় কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে।
এই বিশেষ জলযানটির সাজসজ্জায় বাইরে থেকে বেশ নবাবী ভাব থাকলেও ভেতরটা দেখে কিছুটা আশাভঙ্গ হয়। তবে হাউসবোটের ছাউনি শক্ত পাটাতনে বসার জন্য বেঞ্চ আর দোলনার ব্যবস্থা ছিল। নৌকার ছাদে বৃষ্টিতে ভিজে চারপাশ দেখতে দেখতে এগোতে থাকি মূল হাওরের উদ্দেশে। হঠাৎ থেমে যায় বৃষ্টি। মেঘ কাটিয়ে ঝলমলে রোদ ওঠে।
ঘণ্টা তিনেক চলার পর আমাদের প্রথম গন্তব্য ‘ওয়াচ টাওয়ার’। এখানে একটি ছোট জলাবন আছে। ছোট ছোট নৌকায় দক্ষ মাঝিরা হাঁকডাক দিয়ে জলাবনে ভ্রমণেচ্ছুদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। অনেকে সেখানে নেমে জলাবনের আদাড়েবাদাড়ে সাঁতার কাটছে। বিলম্ব না করে আমরাও ঝাঁপ দেই হাওরের বুকে।
পরবর্তী গন্তব্য ছিল টেকেরঘাট। এখানেই আছে বিখ্যাত নীলাদ্রি লেক। একদিকে টিলাপাহাড় আর অন্যদিকে স্বচ্ছ নীল পানির হ্রদ- এক অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। নীলাদ্রি লেক থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশায় করে চলে যাই লাকমাছড়া। ভারতের সীমান্তঘেঁষা এই এলাকায় সবুজ পাহাড় থেকে নেমে আসে স্বচ্ছ পানির ঝর্ণাধারা।
রাতে আমাদের হাউসবোট টেকেরঘাটেই নোঙর ফেলে। প্রায় শ খানেক হাউসবোট সারি সারি নোঙর করা। বৃষ্টির দেখা নেই। সারা দিনের রোদের তাপ শোষণ করে রাতের প্রথমভাগে হাওর সেই তাপ ছাড়তে থাকে। গরম থেকে বাঁচতে বহু কষ্টে ম্যানেজারকে রাজি করিয়ে হাউসবোটটা হাওরের একটু গভীর জলভাগে এনে নোঙর করি। এরপর রাত কেটে যায় গল্প, আড্ডা আর গানে।
পরদিনের গন্তব্য জাদুকাটা নদী। তবে সেখানে যাওয়ার আগে আমরা ঢু মারি শিমুল বাগানে। প্রায় ১০০ বিঘা জায়গাজুড়ে গড়ে তোলা এই শিমুল বাগানে আছে প্রায় তিন হাজার শিমুল গাছ। সেখানে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি ও ছবি তোলা শেষে আমরা হাউসবোটে করে বারিক টিলা ও জাদুকাটা নদী দেখতে যাই। বারিক টিলার ওপর থেকে মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড় দেখা যায়। খাসিয়া পাহাড় থেকে নেমে আসা জাদুকাটা নদী বারেক টিলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। আমরা সবাই অনেকক্ষণ সেই শীতল জাদুকাটার জলে সাঁতার কাটি। সন্ধ্যার কিছু আগে হাউসবোটটি ফিরে আসে সাহেব বাড়ি ঘাটে।
হাওর ভ্রমণ শেষে রাতে ফের লেগুনা করে সুনামগঞ্জ শহরে ফিরলাম। অবাক হলাম আমাদের কারো ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ না পেয়ে। দেশে কী হচ্ছে তখনো আমরা কিছুই জানতাম না। টার্মিনালের কাছে একটি রেস্টুরেন্টে রাতের খাবার খেতে খেতে জানতে পারলাম ঢাকায় কোটাবিরোধী আন্দোলন নিয়ে গ্যাঞ্জাম হচ্ছে। কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম একে একে বাসগুলো তাদের যাত্রা ক্যানসেল করছে। মনে একরাশ দুশ্চিন্তা। তবে অগ্রিম টিকিট কাটা আমাদের গাড়িটা ঢাকা ফিরবে জানতে পেরে কিছুটা স্বস্তি পেলাম। যথাসময়েই বাসটি ছাড়ল।
অবাক হলাম একটি গাড়িও নেই কোথাও। এমন ভূতুড়ে পরিস্থিতির মুখে আগে কখনো পড়িনি। রাস্তায় গাড়ি ডাকাতের কবলে পড়ে কি না- মনে এমন শঙ্কা চেপে বসে। যানবাহনশূন্য হাইওয়ে দেখে মনে হচ্ছিল হরর মুভির দৃশ্য দেখছি! ভোরের দিকে আবছা আলোতে দেখলাম রাস্তায় সংঘর্ষের চিহ্ন। গাড়ির পোড়া কঙ্কাল আর পুলিশ ব্যারিকেডগুলো উল্টে পড়ে আছে। রাস্তাজুড়ে ছড়ানো নানা সাইজের ইটের টুকরা, পোড়া টায়ার। এরই মধ্যে ড্রাইভার ফোনে জানতে পারেন ঢাকায় কোনো গাড়ি বা পরিবহন ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আমরা পড়লাম অকূল পাথারে। গন্তব্যের যতটা কাছে পারা যায়, ড্রাইভারকে অনুরোধ করি, সেখানে নামিয়ে দিতে। উনি কয়েক দফা যাত্রাবাড়ী দিয়ে প্রবেশ করতে ব্যর্থ চেষ্টা করে শেষমেশ ডেমরায় নামিয়ে দেন।
আমরা প্রথমে উষ্মা প্রকাশ করলেও ড্রাইভারের অপারগতা বুঝতে পেরে নেমে যাই। আমাদের কয়েকজন বন্ধু প্রায় তিন থেকে পাঁচ গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে মোটরসাইকেল ও সিএনজি করে উত্তরা ও মিরপুরের উদ্দেশে রওনা হয়। বাকি আমরা সাতজন মোহাম্মদপুর আসব। বুঝতে পারছিলাম না কীভাবে ফিরব। একটি লেগুনা আমাদের রামপুরা পৌঁছে দিতে রাজি হয়।
রামপুরায় ঢুকেই দেখি চারদিকে ভূতুড়ে নীরবতা। সহকারী পুলিশ কমিশনারের অফিস জ্বলছে। রাস্তার অপর পাশে কিছু বিজিবি সদস্য সতর্ক অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। রাজধানী কেমন দেখে গেলাম, আর এসে কেমন দেখছি। সংঘর্ষের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে। এসব দেখে নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। অবাক হওয়া থামিয়ে আমরা দ্রুত রাস্তা পার হলাম। ভাগ্যক্রমে একটা পিকআপ ট্রাক পেয়ে যাই। লিফট চাইতে ড্রাইভার কারওয়ান বাজার পর্যন্ত এগিয়ে দিতে রাজি হন। কারওয়ান বাজার থেকে নেমে রিকশাযোগে মোহাম্মদপুর ফিরি। সেই রাতেই কারফিউ জারি হয় সারা দেশে। তারপরের ঘটনা তো ইতিহাস! আমরা সবাই জানি। আবু সাঈদ, মুগ্ধদের আত্মত্যাগে সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের এক নতুন অধ্যায়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh