Logo
×

Follow Us

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ২০২৫

সাম্প্রতিক দেশকাল চমৎকার এক সুখী পরিবার

Icon

সৌমিত্র দস্তিদার

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ১০:৫৫

সাম্প্রতিক দেশকাল চমৎকার এক সুখী পরিবার

সাম্প্রতিক দেশকাল পরিবার

মেপেজুকে জীবন চলে না। বিধিনিষেধ থাকবে, এই কর না। ওই করবে না। হাজারো ওজর আপত্তি থাকলেও মনকে কোনো গণ্ডিতে বেঁধে রাখা পৃথিবীর কোথাও সম্ভব হয়নি। আর হবেও না। সেই যে কথায় আছে না, ‘আমার হাত বান্ধিলি, পা বান্ধিলি, মন বান্ধিবি কেমনে!’

কত রকম বিধিনিষেধ, ওজর আপত্তি, কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, তবুও মনে মনে আমি প্রায়ই ঢাকা চলে যাই। শুধু ঢাকা কেন, ইচ্ছে হলেই, মন চাইলেই ঘুরে বেড়াই রাজশাহী, খুলনা, নোয়াখালী, সিলেট বা টাঙ্গাইলের বিস্তৃত জায়গায়। পুরনো ঢাকার লঞ্চঘাট থেকে পেল্লাই জলযানে চড়ে দিব্যি ঘুরে আসি বরিশাল থেকে। বাংলাদেশকে, সেখানকার মানুষজনকে আমি সত্যিই ভালোবাসি।

এখন যেমন আমি বসে আছি মোহাম্মদপুরে। সাম্প্রতিক দেশকালের অফিসে। ছোটখাটো, ছিমছাম, সাজানো গোছানো এই অফিসে এলে মনে হয়, যেন নিজের বাসার ড্রইং রুমে খোশমেজাজে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছি।

এই কাগজের সঙ্গে আমার কবে কীভাবে সম্পর্ক গড়ে উঠল তা এখন আর মনেও পড়ে না। তবে সম্পর্ক গড়ে ওঠার পেছনে মূল কৃতিত্ব মাসুদ রানার, তা পরিষ্কার মনে আছে। এও মনে আছে লালমাটিয়ায় আমার এক বন্ধুর অফিস থেকে রিকশা করে পরম যত্নে মাসুদ আমাকে সাম্প্রতিক দেশকালে নিয়ে গেছিল। তারপর থেকে আমি ওই পরিবারেরই একজন।

এখন কথা হচ্ছে যে, মাসুদ আমাকে পেল কি করে! মাসুদ বোধহয় আমাকে আগে থেকেই চিনত। নাম শুনেছিল। ওই ছবি টবি বানাই, বামপন্থি রাজনীতিতে বিশ্বাসী। ও আমাকে প্রথম বদরুদ্দীন উমরের বাসায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে বেরিয়ে বলে, একদিন আমাদের অফিসে আপনাকে নিয়ে যাব। মাঝে মধ্যে লিখতে হবে। যাব যাব করি। যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। একদিন, আমার বন্ধু জাকির হোসেনের অফিসে বসে আছি। এমন সময় মাসুদের ফোন। বললাম, চলে এসো। আজ এক্ষুণি যাব।

ব্যস, চলে গেলাম। তখনো যে কত নাটক বাকি, তা কি ছাই নিজেই জানতাম! মাসুদ সবার সঙ্গে আলাপ করাতে লেগেছে। আরাফাত, আলমগীর, তাহমিনা, এই অবধি হয়ে একটা ঘরে বসে থাকা এক তরুণীর নাম নাসরিন বলতেই বিদ্যুৎ গতিতে আমি রাজশাহী চলে গেলাম। মনে পড়ে গেল, তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গেছি আমার ছবি দেখাতে। তখন রাজশাহী বা খুলনার কয়েকজন তরুণ ছাড়া ঢাকায় সংবাদপত্র মহলে অন্তত সেভাবে কেউ চেনে না।

সিনেমা শো হয়ে যাবার পরে গেস্টরুমে বসে দু’একজনের সঙ্গে আড্ডা মারছি। একজন একটা ফোন নম্বর দিয়ে বললেন যে, এনাকে দাদা একটা ফোন করবেন। আমাদের রাজশাহীর মেয়ে। এখন ঢাকায় বড় এক সাপ্তাহিকে আছেন। ওরা চলে যেতে কী মনে করে ফোন করলাম। খুব মিষ্টি করে বল্লেন, লিখুন না আমাদের কাগজে। ঢাকায় এলে অবশ্যই আসুন অফিসে। খুশি হব।

মাসুদের পাল্লায় এখন যে তরুণীর মুখোমুখি, এখন টের পেলাম ইনিই সেই নাসরিন, যিনি আমাকে প্রথম সাম্প্রতিক দেশকালে লিখতে বলেছিলেন ফোনে, না চিনেই। মাসুদকে হেসে বললাম, ভাই তুমি নিয়ে এলে ঠিক। কিন্তু সামনের এই নাসরিন প্রথম তোমাদের কাগজের নাম বলেছিল আমাকে।

সেই থেকে নাসরিন আমার একান্ত আপন, নিজের ছোট বোন। সম্পাদক ইলিয়াস উদ্দিন পলাশের সঙ্গে একটু পরে আলাপ হলো। প্রথমে সামান্য গম্ভীর লাগলেও মিশতে মিশতে এখন রাশভারী সম্পাদকের বাইরে ভাই হয়ে গেছে কখন, টেরও পাইনি। দেখতে দেখতে বেশ ক’বছর হয়ে গেল। বাংলাদেশে একটু-আধটু পরিচিতি হয়তো আমার হয়েছে; কিন্তু সাম্প্রতিক দেশকাল আমার এক্কেবারে নিজের জায়গা, নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম। সবসময়, সব সংখ্যায় কথা দিয়েও লেখা দিয়ে উঠতে পারি না বলে অপরাধবোধে ভুগি। আমি জানি মাসুদ, নাসরিন সে কারণে আমার ওপর রাগ করে। আড়ালে মুণ্ডুপাত করে। আবার এও জানি ওরা আমাকে ভালোবাসে বলেই অভিমান করে। ওরাও জানে এই যে দীর্ঘদিন আমি ওখানে যেতে পারছি না, একসঙ্গে খাবার ভাগ করে আড্ডা মারতে পারছি না, তাতে আমি কম যন্ত্রণা পাচ্ছি না। লকডাউন উঠলে, ঢাকা গেলে ঠিক একবার দেশকাল অফিসে যাব তা নিয়ে কারু কোথাও সংশয় নেই। সাম্প্রতিক দেশকালে আমি আর এখন লেখক না, তাদের পরিবারের একজন সদস্য।

কিন্তু নিজের কাছে অন্তত লুকিয়ে লাভ নেই যে সেদিক দিয়ে আমি পরিবারের কু’সন্তান। কখনো কোনো কাজ ঠিক সময়ে করে উঠতে পারিনি। আমার যে একমাত্র কাজ-লেখা, সেটা বহু সময় দিচ্ছি দেব করেও দেওয়া হয়ে ওঠেনি। বিজ্ঞাপন বেরিয়ে গেছে। তাও আজ কাল করে আমি লেখা দিইনি। কেন দিইনি তার হাজার ব্যাখ্যা থাকলেও নিজের দোষ ঢাকার কোনো যুক্তি নেই। তাও আমাকে আমার পরিবার সরিয়ে দেয়নি। ব্রাত্য করে দেয়নি। এটা অবশ্যই সাম্প্রতিক দেশকালের বন্ধুদের ঔদার্য।

বহু বছর লেখালেখি করছি বলে জানি কী চমৎকার সব বিশেষ সংখ্যা সাম্প্রতিক দেশকাল বের করেছে। যা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক একটা মাইলফলক। দেশভাগ থেকে কাজী নজরুল ইসলাম বিভিন্ন বিষয়ে পরম যত্ন নিয়ে, বিপুল পরিশ্রম করে, দক্ষতার সঙ্গে যেভাবে আমার সহকর্মীরা বের করেছেন, তা দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় আমি বুঝি। এর জন্য কোনো প্রশংসাই যথেষ্ট নয়। এটি সম্ভব হয়েছে সাম্প্রতিক দেশকালের টিম স্পিরিটের জন্য। পলাশের দক্ষ নেতৃত্বে যে টিম গড়ে উঠেছে তাদের কাছে কোনো কাজই কঠিন নয়।

একটা পত্রিকা, যার বয়স বোধহয় আট বছর, সে ইতিমধ্যেই জনমনে সাড়া ফেলেছে। আমি নিজে ঢাকার বিভিন্ন স্টলে গিয়ে দেখেছি, কীভাবে পথ চলতি সাধারণ লোকজন সাম্প্রতিক দেশকালের স্পেশাল ত্রৈমাসিক ম্যাগাজিন আগ্রহ নিয়ে কিনছেন। হকার যে উৎসাহে কাগজ বাড়িয়ে দিচ্ছে তাতে বোঝা যায় যে, পত্রিকাটির চাহিদা সম্পর্কেও সে ওয়াকিবহাল। এটা বুঝতে পারি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কলেজ স্ট্রিটে পাতিরাম ও হালের ধ্যান বিন্দুতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাগজ পত্রিকার কেনাবেচা দেখি বলে। 

প্রথমেই বলেছি, পরিবারের একজন বলে যত চেঁচামেচিই করি না কেন, অনেক সময়েই কথা দিয়েও ঠিকঠাক লেখা না দিয়ে আমি অন্যায় করি। দোষ ঢাকছি না, তবে এটাও ঠিক যে, সাম্প্রতিক দেশকাল এমন উঁচু দরের, মানে নিজেদের নিয়ে গেছে সেখানে নিজের লেখা কেমন হবে সেই দুঃশ্চিন্তা নিয়েও অনেক সময় লেখা দিইনি। ভেতরে ভেতরে এক ধরনের ভয় কাজ করেছে, পারব তো ঠিকঠাক লিখতে!

এই যে এখনো এত কথা লিখছি, জানি না তা মানের দিক দিয়ে ঠিক আছে কিনা; কিন্তু এটা ঠিক যা লিখলাম, যেটুকু বললাম সব নিখাদ অন্তর থেকে। 

আসলে সাম্প্রতিক দেশকাল নিছক কোনো কাগজ, পত্রিকা নয়, এ হচ্ছে চমৎকার এক সুখী পরিবার। আমি সবসময় চাইব এই পরিবারের সুখে দুঃখে সারাজীবন থেকে যেতে। সাম্প্রতিক দেশকাল আরও অনেক বছর মাথা উঁচু করে পথ চলুক। যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিনই যেন তার নীরব প্রেমিক হয়ে থেকে যেতে পারি।


সৌমিত্র দস্তিদার 
ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫