
চক্রাকারে চলছে জীবন- শুরু থেকে শেষ, আবার শুরু। আর বছর শেষে সময়ের পাতা উল্টিয়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব কষা। এভাবেই দৌড়ায় বছর থেকে যুগ, যুগ থেকে শতাব্দী। চক্রের আবর্তে বিলীনের পথে এই শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ বছরটিও, ২০২০।
প্রবাদ আছে- শেষ ভালো যার, সব ভালো তার; কিন্তু পুরো পৃথিবীর মনুষ্য সমাজই যেন কাটাল কয়েক শতাব্দীর বাজে বছর। নানা ঘটন-অঘটনের মাধ্যমে সবচেয়ে আলোচিত ছিল শিক্ষা খাত।
বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালেও বিষকাঁটায় বিদ্ধ হয়েছে শিক্ষাঙ্গন। পাঠ চুকিয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন শিক্ষক-কর্মচারী। স্কুল-কলেজের দ্বার খোলার সুযোগ না দিয়েই একাডেমিক ক্যালেন্ডার থেকে হারিয়ে গেল একটি বছর। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকাল ছাড়া এমন টানা বন্ধের ঘটনা এই প্রথম। এর মধ্যে বেশি আলোচনার জন্ম দেয় অটোপাস পদ্ধতি। করোনার কৃপায় ইতিহাস গড়ে সবাই পাস! এ থেকে বাদ যায়নি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক পরীক্ষা উচ্চ মাধ্যমিকও।
স্বপ্ন ভেঙে স্বপ্নপূরণ
বছরে বছরে বাড়ছে পাসের হার। এবার গিয়ে ঠেকেছে একেবারে শতভাগে। তবে সেটি শিক্ষকদের কৃপায় নয়, বৈশ্বিক মহামারির কল্যাণে। এই মরণঘাতী ভাইরাসের কারণে গত ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। ফলে এ বছর আর নেয়া সম্ভব হয়নি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী, জেএসসি ও জেডিসি পরীক্ষা। সর্বশেষ বাতিল করা হয় এইচএসসি। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষাও হয়নি। সবাই এবার অটোপাস।
অন্যান্য পরীক্ষা বাতিলে অবশ্য কোনো বিতর্কের সৃষ্টি হয়নি; হয়েছে কেবল এইচএসসি নিয়ে। বলা হয়েছে, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের গড় অনুযায়ী তাদের ফল নির্ধারণ করা হবে। এই সিদ্ধান্তের পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত। আবার অনিবার্য কারণে এমন অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত না নিয়ে উপায়ও থাকে না। যেমনটি হয়েছিল ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়। ওই বছর ডিগ্রি পরীক্ষার জন্য যারা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফি জমা দিয়েছিলেন, তাদের সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হয়।
গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘ফল প্রকাশ নিয়ে আমাদের উৎকণ্ঠা দূর হলেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, কীভাবে মূল্যায়ন হবে। এটি স্বাভাবিক যে, এই মূল্যায়ন বেশ কঠিন একটি কাজ। তবে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তার ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক আসবেই। পরামর্শক কমিটি অবশ্য এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশ জরুরি। কারণ এইচএসসি ফলের ওপরই এই শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা নির্ভরশীল।’
নতুন শিক্ষাব্যবস্থা
মহামারির কারণে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চলমান ছুটি আবারও বাড়িয়ে ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র অবশ্য বলছে, স্কুল-কলেজ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকার সম্ভাবনাই বেশি। তাই আগামী বছরের শিক্ষা কার্যক্রম কেমন হবে তার প্রস্তুতি এখন থেকেই চলছে। সে অনুযায়ী নতুন বছরে বদলে যাচ্ছে গতানুগতিক শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যমান কারিকুলামের আওতায় বছরজুড়েই অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা অব্যাহত থাকবে বলে জানা যায়। ২০২০ শিক্ষাবর্ষের ঘাটতি পূরণ করতে বিশেষ ব্যবস্থাও নেওয়া হবে। তবে করোনা-পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসছে, তার ইঙ্গিত আগেই দিয়ে রেখেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) শিক্ষার্থীদের জন্য আগামী জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের অ্যাসাইনমেন্ট তৈরির প্রস্তুতি নিয়েছে। অন্যদিকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর প্রস্তুতি নিয়েছে বছরজুড়েই অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থী মূল্যায়নের। এ ছাড়াও চলবে অনলাইনে এবং ভিডিও রেকর্ড করা পাঠদান। করোনাকালীন পরিস্থিতি না থাকলেও অ্যাসাইনমেন্ট ব্যবস্থা ও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম সারাবছরই চলবে। দীর্ঘদিন থেকেই এ ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করেও নানা বাধায় পারছিল না মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। কভিড-১৯ পরিস্থিতি এবার সেই সুযোগ করে দিয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে এনসিটিবি সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে এ বছরের ঘাটতির জন্য কিছু নির্দেশনা তৈরি করা হয়েছে। নতুন কারিকুলামের কিছু কনটেন্ট যাবে পুরাতন কারিকুলামে। প্রজেক্ট ওয়ার্ক থাকবে শিক্ষার্থীদের জন্য। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা না যায় তাহলে জানুয়ারি থেকে মার্চের অ্যাসাইনমেন্ট রেডি করব। অনলাইন ক্লাস আগের মতোই চলবে।’
হিত-অহিত
সরাসরি পাঠদান বন্ধ থাকায় লম্বা সময়ে ঘরবন্দি শিক্ষার্থীদের দুরন্তপনায় অস্থির অভিভাবকরা। অবশ্য ক্ষতি কিছুটা পুুষিয়ে নিতে টেলিভিশনে পাঠদান চালু থাকলেও সেই ক্লাসে আগ্রহ নেই বেশিরভাগেরই। আবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও অনলাইনভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
উন্নত বিশ্বে আগে থেকেই এমন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে এমন শিক্ষা কার্যক্রমে হিতের পাশাপাশি রয়েছে কিছু অহিতও। কেননা এই সুযোগে শিক্ষার্থীরা আরও বেশি করে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তরুণ প্রজন্ম এমনিতেই অনলাইন আসক্তিতে এগিয়ে, আর এখন অবস্থা হয়েছে- ‘এমনিতেই নাচুনি বুড়ি, তার ওপর ঢোলের বাড়ি’-এর সেই প্রবাদের মতো। ক্লাসকালীন তো আছেই, পরবর্তী সময়েও তারা মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ থেকে মুখ ফেরাতে পারছেন না।
ভার্চুয়াল দুনিয়াই যেন তাদের কাছে এখন বাস্তব। কেউ কেউ পা বাড়াচ্ছে ইন্টারনেটে পেতে রাখা নানা ফাঁদে। পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সঙ্গে শারীরিক সমস্যার দিকেও এগিয়ে যাচ্ছে কোমলমতিরা। অধিক সময় মোবাইল বা কম্পিউটারে বসে থাকায় চোখে সমস্যা ও জয়েন্ট পেইন সঙ্গী হচ্ছে। সেই সঙ্গে তাদের মধ্যে বাড়ছে অলসতা।
তাদের জীবন কি মূল্যহীন?
শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে- এমন যুক্তিতে করোনাকালেই দ্রুত মাদ্রাসা খোলার দাবি জানিয়ে আসছিলেন আলেমরা। সেই দাবির মুখে ১২ জুলাই থেকে কেবল হাফিজিয়া মাদ্রাসা ও হিফজখানা চালুর অনুমতি মিলে। সে সুযোগটা নেয় বেশকিছু কওমি মাদ্রাসাও। তাই ২৭ আগস্ট এক ঘোষণায় কওমি মাদ্রাসা খুলে দিয়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সরকারের এই দ্বৈতনীতিতে সৃষ্টি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
অনেকেই প্রশ্ন ছুড়েছেন- যেখানে মহামারির কারণে চলতি বছর প্রাথমিক ও ইবতেদায়ি সমাপনী, জেএসসি ও জেডিসি এবং এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল হয়েছে; সেখানে কওমি মাদ্রাসা খুলে দেওয়া হলো কোন যুক্তিতে? এসব প্রতিষ্ঠানে যারা পড়েন, তাদের জীবনের কি কোনো মূল্য নেই?
এ প্রসঙ্গে কওমি শিক্ষা বোর্ড বেফাক মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমেদ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘আমাদের বছর হিসাব করা হয় আরবি মাস ধরে। রমজান থেকে শুরু হয়ে পরবর্তী বছরের শাওয়াল মাস পর্যন্ত একটি শিক্ষাবর্ষ। আর শাবান মাসে সাধারণত বার্ষিক পরীক্ষা হয়। ফলাফল প্রকাশ হয় রমজানে। এ বছর সেটি হয়নি বলে পুরো সিস্টেমে একটি জট পাকিয়ে গেছে। তাই সরকারের অনুমতি নিয়ে মাদ্রাসাগুলো খুলে দেওয়া হয়।’
মেরুদণ্ডে ফাটল
শিক্ষক যখন ‘ভ্যানচালক’, ‘ফল বা তরকারি বিক্রেতা’, কিংবা ‘রাজমিস্ত্রির জোগালি’- তখন লজ্জিতই হতে হয়। কারণ তারাই তো জাতির মেরদ- তৈরির কারিগর। আজ তাদেরই শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর জো নেই। করোনাকালীন দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি সংকটে শিক্ষার্থীদের বেতনের ওপর নির্ভরশীল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
নয় মাসেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকায় বেতন পাচ্ছেন না শিক্ষকরা। তাই পেটের দায়ে লজ্জার আবরণ সরিয়ে রাস্তার ধারে ফল কিংবা সুরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি করতেও দেখা যায় অনেককে। আবার অঘোষিত লকডাউনকালে অন্ধকারে মুখ ঢেকে খাবারের জন্য হাত পাততে বাধ্য হন কেউ কেউ। নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন তিন শিক্ষক। ভাড়া দিতে না পেরে বিদ্যালয় বিক্রির বিজ্ঞাপনও বিদ্ধ করেছে হৃদয়। জীবন-জীবিকার লড়াইয়ে টিকে থাকতে করছেন পেশা বদল।
দেশের ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেনে প্রায় আট লাখ শিক্ষক-কর্মচারী কর্মরত বলে জানান কিন্ডারগার্টেন ও সমমান স্কুল রক্ষা জাতীয় কমিটির প্রধান সমন্বয়কারী এম এ ওয়াদুদ। বললেন, ‘সরকারি অনুদানের সুযোগ না থাকায় স্বাভাবিক অবস্থাতেই কিন্ডারগার্টেনগুলোর চলতে কষ্ট হয়। সেখানে এক বছর ধরে বেতন না পেলে বা ২০ শতাংশ পেলে কী অবস্থা হয়, তা সহজেই অনুমেয়। নিরুপায় হয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন। অনেকে আবার পেশা পরিবর্তন করেছেন জীবন বাঁচাতে।’
অঙ্গে জড়িয়ে বিষকাঁটা
নানা কারণেই আলোচনায় সিলেট এবং মুরারিচাঁদ (এমসি) কলেজ শাখা ছাত্রলীগ। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুনোখুনি, হোস্টেল পুড়িয়ে দেওয়া, অস্ত্র নিয়ে মিছিল- এসব অপকর্মের কারণে একাধিকবার কমিটি বাতিল কিংবা স্থগিতের মতো কঠোর সিদ্ধান্তও নিতে হয়েছে কেন্দ্রকে। তবে এতে দমে যাননি সিলেট ছাত্রলীগের টিলাগড় এলাকার নেতাকর্মীরা। এমনকি করোনাকালে যখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ; ঠিক সেই সময়ে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাটিও ঘটে তাদের হাত ধরে।
এক গৃহবধূকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে জোরপূর্বক ছাত্রাবাসের ভেতরে প্রাইভেটকারে নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় স্বামীকে আটকে রেখে ওই গৃহবধুকে ধর্ষণ করে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন। এ ঘটনায় মহানগর পুলিশের শাহপরাণ থানায় গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে মামলা করেন। এরপরই র্যাব ও পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হয় আটজন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের ছাত্রত্ব এবং সার্টিফিকেট বাতিল করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। পাশাপাশি স্থায়ীভাবে এমসি কলেজ থেকেও বহিষ্কার করা হয়। ডিএনএ টেস্টের রিপোর্টেও এ চারজনের জড়িত থাকার প্রমাণ মিলেছে। অন্যরা ধর্ষণকাণ্ডের সহযোগী।
করোনাকালে বেশ কয়েকটি মাদ্রাসাতেও শিক্ষকের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ধর্ষণ ও বলাৎকারের ঘটনা দেশব্যাপী ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। এমনই একটি ঘটনা নিয়ে গত ২১ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন শামীমের একটি স্ট্যাটাস বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে।
‘মানবিক বলাৎকারকারী’ শিরোনামে একটি মাদ্রাসার শিক্ষক নাছির উদ্দিনের বরাত দিয়ে তিনি লিখেন, ‘স্যার, ওরা তো খুব ছোট। তাই আমি সবসময় চেষ্টা করি, যেন ওরা বেশি ব্যথা না পায়। আমি তো ওদের শিক্ষক, ওরা ব্যথা পেয়ে কান্নাকাটি করলে আমার খুব কষ্ট লাগে।’ মাদ্রাসার হোস্টেলের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্বে থাকার সুযোগ নিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে অনেক শিশুকেই নিয়মিত নির্যাতন করতেন নাছির উদ্দিন।