Logo
×

Follow Us

ফিচার

মানসিক স্বাস্থ্যের বিশ্ব প্রেক্ষাপট

Icon

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ

প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৪০

মানসিক স্বাস্থ্যের বিশ্ব প্রেক্ষাপট

প্রতি বছর ১০ অক্টোবর বিশ্বজুড়ে পালিত হয় বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস (World Mental Health Day)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ও ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ (ডব্লিউএফএমএইচ) মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বোঝাতে এবং মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রতি সহানুভূতি বাড়াতে এই দিবসটি পালন করে। তবে বাস্তবতা হলো সচেতনতা বাড়লেও চিকিৎসা ও সহায়তার সুযোগ ততটা উন্নত হচ্ছে না। চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা, বিশেষজ্ঞের অভাব, সামাজিক কুসংস্কার, আর্থিক অসাম্য এবং প্রশাসনিক জবাবদিহির ঘাটতি-সব মিলিয়ে মানসিক স্বাস্থ্য খাত আজও এক গভীর সংকটে রয়েছে।

মানসিক স্বাস্থ্য : সুস্থতার অপরিহার্য উপাদান

মানসিক স্বাস্থ্য শুধু মানসিক রোগ থেকে মুক্ত থাকার বিষয় নয়; এটি এক ব্যক্তির চিন্তা, অনুভূতি, আচরণ ও সামাজিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করার সক্ষমতা। একজন মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ জীবনের প্রতিকূল সময়েও নিজেকে সামলে নিতে পারেন, সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেন। ডব্লিউএইচও যথার্থই বলেছে, মানসিক সুস্থতা ছাড়া শারীরিক সুস্থতাও পূর্ণ হতে পারে না।

বর্তমান চিত্র : পরিসংখ্যানে উদ্বেগের ইঙ্গিত

বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট (ডব্লিউএইচও, ২০২৩) : বিশ্বে প্রতি আটজনে একজন কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। প্রায় ৯৭ কোটি মানুষ ডিপ্রেশন, উদ্বেগ বা অন্যান্য মানসিক রোগে আক্রান্ত। আত্মহত্যা বিশ্বে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে চতুর্থ প্রধান মৃত্যুর কারণ। প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় আট লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন।

বাংলাদেশের বাস্তবতা (জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য জরিপ, ডিজিএইচএস, ২০২২) : দেশের প্রায় ১৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ১৪ শতাংশ আক্রান্ত। প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় মাত্র ০.১৩ জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ রয়েছেন, যেখানে ডব্লিউএইচওর মানদণ্ড অনুযায়ী প্রয়োজন অন্তত ১০ জন।

৬০ শতাংশের বেশি রোগী চিকিৎসা নেন না লজ্জা, কুসংস্কার ও ভয় থেকে। ৯৫ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা এখনো শহরকেন্দ্রিক; গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এর থেকে বঞ্চিত।

চিকিৎসার চ্যালেঞ্জ

বিশেষজ্ঞ ও অবকাঠামোগত সংকট : বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রধানত জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পাবনা মানসিক হাসপাতাল এবং কিছু মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সীমিত ইউনিটে সীমাবদ্ধ। একজন বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব প্রায় ৮-১০ লাখ রোগী, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য অনুপাত।

কুসংস্কার ও সামাজিক লজ্জা : অনেকেই মনে করেন, মানসিক রোগ মানে ‘পাগল’, ফলে চিকিৎসার বদলে লোকচক্ষুর আড়ালে রোগ লুকানো হয় বা জাদুটোনা-ঝাড়ফুঁককে ভরসা করা হয়।

চিকিৎসা ব্যয় ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা : মনোরোগ বিশেষজ্ঞের ফি, নিয়মিত কাউন্সেলিং সেশন ও ওষুধের খরচ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ফলে দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিকিৎসা নিতে পারে না।

সরকারি বাজেটের অপ্রতুলতা : বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বাজেটের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ১ শতাংশেরও কম। ফলে প্রশিক্ষণ, গবেষণা ও জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম স্থবির হয়ে আছে।

আইন ও তদারকির ঘাটতি : মানসিক স্বাস্থ্য আইন ২০১৮ থাকলেও এর প্রয়োগ সীমিত। হাসপাতালের মান নিয়ন্ত্রণ, রোগীর অধিকার ও সেবার গুণগত মান তদারকির জন্য কার্যকর প্রক্রিয়া অনুপস্থিত।

তথ্যসংগ্রহের দুর্বলতা : আত্মহত্যা ও মানসিক রোগের প্রকৃত তথ্য লুকানো হয় বা ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়, ফলে নীতিনির্ধারণের জন্য সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।

জবাবদিহি ও নীতিগত ব্যর্থতা

নীতিগত ঘাটতি : জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য নীতিমালা কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষণ ও নিয়োগে পর্যাপ্ত বরাদ্দ নেই। স্কুল-কলেজে ‘মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট সেল’ গঠনের নির্দেশনা থাকলেও বেশির ভাগ স্থানে তা কার্যকর নয়। জেলখানা, মাদক পুনর্বাসন ও আশ্রয়কেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রায় নেই বললেই চলে।

প্রশাসনিক জবাবদিহির অভাব : মানসিক রোগীদের প্রতি অবহেলা বা নির্যাতনের ঘটনায়ও দায় নির্ধারণ হয় না। আত্মহত্যার সংবাদ প্রচারে মিডিয়ার দায়িত্বশীলতা অনুপস্থিত, যা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

পরিশেষে, মানসিক স্বাস্থ্য শুধু ব্যক্তিগত নয়, বরং এটি জাতীয় উন্নয়নের মৌলিক উপাদান। একজন মানসিকভাবে অসুস্থ নাগরিক তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগ মানে শুধু চিকিৎসা নয়, বরং একটি সহমর্মিতাপূর্ণ, সচেতন ও কর্মক্ষম জাতি গঠন। আমরা সবাই মানসিকভাবে সুস্থ থাকার অধিকারী। মানসিক অসুস্থতা কোনো লজ্জা নয়Ñএটি যত্ন, সহানুভূতি ও চিকিৎসার দাবি রাখে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫